অস্ট্রেলিয়া: ব্রিটিশ শাসনামল ও আদিবাসীদের করুণ কাহিনী

আমাদের চোখে অস্ট্রেলিয়া মানেই একসময়ের অপরাজেয় ক্রিকেট দল। তারপর হয়তো মাথায় আসে সিডনি হারবারে অবস্থিত পৃথিবী বিখ্যাত সিডনি অপেরা হাউজ, যেখানে মিডিয়া জগতের অসাধারণ সব শিল্পব্যক্তিত্ব পরিবেশনা করেছেন। তাছাড়া কারো কারো মেলবোর্নের ক্রিকেট স্টেডিয়ামে হওয়া ২০১৫ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেটের দ্বিতীয় কোয়ার্টার ফাইনালে বাংলাদেশ বনাম ভারতের ম্যাচটির কথা মনে পড়ে। কিন্তু আজকের এই লেখাটি এসব কিছু নিয়েই নয়। অস্ট্রেলিয়ার একটি ইতিহাস আছে, এখানকার মানুষের ইতিহাস আছে, রীতিনীতি কিংবা প্রথা আছে। এখন আমরা অস্ট্রেলিয়াকে যেভাবে দেখি, আজ থেকে ৩০০-৪০০ বছর আগে এসবের ছিটেফোঁটাও ছিল না।
প্রশান্ত মহাসাগর ও ভারত মহাসাগরে ঘিরে থাকা একটি মহাদেশ অস্ট্রেলিয়া, যার আয়তন ৭৫ লাখ বর্গ কিলোমিটারের কিছু বেশি। নিউজিল্যান্ড, তাসমানিয়া সহ বেশ কিছু ছোট দ্বীপ এই মহাদেশের অংশ। বিশ্ব ব্যাঙ্কের ২০১৭ সালের রিপোর্ট অনুসারে, দেশটির জনসংখ্যা প্রায় ২৪.৬ মিলিয়ন। আইএমএফের ২০১৮ সালের রিপোর্ট অনুসারে, জিডিপি গড় আয়ের র্যাঙ্কে দেশটির অবস্থান ১০ম। তবে এই সবকিছুই এখনকার কথা। চলুন ফেরা যাক বেশ কিছু সময় পূর্বের ইতিহাসে।

শিকলে বাঁধা আদিবাসীরা; Image Source: welcometocountry.org
তারা ছাড়াও আরেকটি আদিবাসী দল আছে, যাদেরকে বলা হয় টরেস স্ট্রেইট আইল্যান্ডার। তাদের আগমনের ইতিহাস এত পুরনো নয়, তবে তারা এসেছিল অস্ট্রেলিয়া ও পাপুয়া নিউ গিনির মধ্যকার দ্বীপমালা থেকে। যেহেতু অস্ট্রেলিয়া বেশ সমতল ও শুষ্ক মাটির একটি জায়গা, তাই এখানে খুবই কম ফসল উৎপাদন করা যেতো। সেই কারণে আদিবাসীরা পশুপাখি শিকার ও সংগ্রহ করে তাদের সমাজব্যবস্থা পরিচালনা করতো। তাদের নিজস্ব ভাষা, ধর্মীয় বিশ্বাস, রীতিনীতি ও প্রথা তারা পালন করতো এবং এখনো অনেকে সেই ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসরত এই আদিবাসীদের ভাগ্যে একে একে দুর্দশা নেমে এলো, যখন ইউরোপ থেকে লোকজন আসা শুরু করলো এবং ধীরে ধীরে তাদের জীবন ব্যবস্থা, বসবাসের অধিকার হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হচ্ছিলো।
সপ্তদশ শতাব্দীর শুরুর দিকে মহাদেশটি অন্বেষণের উদ্দেশ্যে নেদারল্যান্ডস থেকে ডাচ বাহিনী এলো এবং ১৬০৬ সালে মহাদেশটির নাম দিল নিউ হল্যান্ড। কিন্তু জায়গা দখলের কোনো উদ্দেশ্য তাদের ছিল না। ডাচ নাবিক উইলেম জ্যান্সযের নেতৃত্বে বেশ কিছু মানুষ সেখানে গিয়েছিল। এরপর ১৬৮৮ সালে প্রথম কোনো ইংরেজ ব্যক্তিত্ব দেশটির উত্তর-পূর্ব তীরে পা রাখেন এবং এরপর থেকেই একে একে ব্রিটিশরা পাড়ি জমাতে শুরু করে।
জেমস কুকের নাম আমরা অনেকেই হয়তো শুনেছি। তিনি একজন ব্রিটিশ পরিব্রাজক, দিকনির্দেশক, মানচিত্র নির্মাতা ও ব্রিটেনের রাজকীয় নৌবাহিনীর ক্যাপ্টেন ছিলেন। তিনি ক্যাপ্টেন কুক হিসেবে বেশি পরিচিত। ক্যাপ্টেন কুকের অস্ট্রেলিয়া অভিযানের পর ব্রিটিশরা তাদের উপনিবেশ স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিল। এরই পরিপ্রেক্ষিতে নিউ সাউথ ওয়েলসে একটি ফৌজদারী কলোনী প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ক্যাপ্টেন আর্থার ফিলিপের নেতৃত্বে অনেকগুলো জাহাজ তারা পাঠালো। একইসাথে ব্রিটেন থেকে শত শত কারাবন্দীকে এখানে নিয়ে আসলো।

অস্ট্রেলিয়ায় ব্রিটেনের উপনিবেশ স্থাপন; Image Source: nationalgeographic.com.au
ভেবে দেখুন একবার, একটি বিশাল এলাকা জুড়ে ৬০,০০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে যাদের বসবাস, সেখানে অচেনা, আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রসজ্জিত কিছু বহিরাগত আসছে এবং সাথে করে নিয়ে আসছে হাজার হাজার কুখ্যাত অপরাধী। আদিবাসীদের জায়গা দখল করে নিয়ে নিজেদের মতো করে শাসন করার চেষ্টা করছে তারা। কলোনির পর কলোনি স্থাপন করছে।
পুরো বিষয়টি চিন্তা করতে কেমন লাগছে? তাছাড়া ইতিহাস থেকে আমরা এটাও জানি, ব্রিটিশরা যেসব দেশে উপনিবেশ গড়েছে, সেসব দেশের মানুষ কতটা অত্যাচারিত হয়েছে। দুর্ভাগ্যবশত, অ্যাবরিজিন বা অস্ট্রেলিয়ার আদিম অধিবাসীদের ক্ষেত্রেও একই ভাগ্য অপেক্ষা করছিল। তার মধ্যে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা নিচে সংক্ষিপ্ত আকারে উল্লেখ করা হলো।
১৮২৪ সাল থেলে ১৮৩১ সালের মধ্যে তাসমানিয়ায় প্রায় ১,০০০ আদিবাসী মারা যায়, ইতিহাসে যা পরিচিত তাসমানিয়ার ব্ল্যাক ওয়ার হিসেবে। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, এর সম্পর্কে হয়তো খোদ অস্ট্রেলীয়রাই সঠিকভাবে জানেন না। ব্ল্যাক ওয়ারের ঘটনা অনেকটা এরকম।

তাসমানিয়ার ব্ল্যাক ওয়ার; Image Source: theconversation.com
১৮৩৪ সালে পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার পিনজারা নামক একটি জায়গায় প্রায় ১৫-৩০ জন আদিবাসীকে হত্যা করা হয়। গভর্নর জেমস স্টারলিংয়ের নেতৃত্বে এই হত্যাকান্ডটি ঘটে, যা ইতিহাসে ‘পিনজারা হত্যাকান্ড’ হিসেবে পরিচিত। ঘোড়া কিনতে যাওয়া দুজন ব্রিটিশের উপর স্থানীয় আদিবাসীরা আক্রমণ করে। এতে একজন মারা যায়। পরবর্তীতে একদল আদিবাসীকে পেয়ে স্টারলিং ধারণা করেন, এরাই সেই দল যারা সেই ব্রিটিশকে হত্যা করেছে। তিনি তাদের সবাইকে হত্যা করার আদেশ দেন।
বিভিন্ন রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, ব্রিটিশ শাসনামলে অস্ট্রেলিয়ায় যত বেশি মানুষ মারা গেছে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ও ভয়াবহতার শিকার হয়েছে কুইন্সল্যান্ডে। ১৮৪২ ও ১৮৪৭ সালে ১৫০ জনের এর মতো আদিবাসীদের বিষ খাইয়ে হত্যা করা হয়। আদিবাসীদের কিছু উপহার প্রদান করা হয়, যার মধ্যে মিশ্রিত ছিল বিষ। সহজ সরলপ্রাণ আদিবাসীরা খুশি মনেই উপহার গ্রহণ করে এবং ঘৃণ্য এই বর্বরতার শিকার হয়।

১৮৭৬ সালে কুইন্সল্যান্ডের ক্রিন ক্রিকের কাছে হওয়া সংঘর্ষ; Image Source: sbs.com.au
ভয়ানক বসন্ত রোগেও প্রচুর আদিবাসী মারা যায়। ধারণা করা হয়, আদিবাসীদের নিঃশেষ করে দেওয়ার জন্য ইচ্ছা করেই এই রোগটির বিস্তার প্রতিরোধ করা হয়নি। ব্রিটিশরা যখন অস্ট্রেলিয়ায় আসে তখন প্রায় সাড়ে সাত লাখ আদিবাসী এখানে বসবাস করতো। ব্রিটিশদের পুরো শাসনামল জুড়ে হাজার হাজার আদিবাসীকে হত্যা করা হয়। তাদের জীবনযাপন আর ইউরোপিয়ানদের জীবনপ্রথা ছিল একদমই আলাদা।
ইউরোপিয়ানদের আগমনের পর আদিবাসীদের অস্তিত্ব বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। তাদের সংস্কৃতি, প্রথা, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে। পরিবার, দল, গোষ্ঠী বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এই একই ঘটনা আমরা আমেরিকা ভূখণ্ডের রেড ইন্ডিয়ানদের ক্ষেত্রেও দেখতে পেয়েছি। এত কিছু ঘটে যাওয়ার পরও অনেকগুলো ঘটনা এখনো পুরোপুরি স্বীকারোক্তি পাচ্ছে না। অনেকেই তাদের ক্ষেত্রে 'গণহত্যা' শব্দটি উচ্চারণ করেন। তাদেরকে প্রকৃতপক্ষেই গণহারে হত্যা করা হয়েছে।
Post a Comment